চোল যুগের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব আলোচনা করো।

চোল যুগের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব আলোচনা করো।

 চোল যুগের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব আলোচনা করো।

চোল যুগের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব আলোচনা করো।

চোল শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে রাজা সকল ক্ষমতার অধীশ্বর ছিলেন । চোল রাজারা দারুণ জাঁক-জমকে থাকতেন । তাঁদের অধীনে অসংখ্য কর্মচারী ও সেনা ছিল। চোল রাজ্যের আদি রাজধানী ছিল তাঞ্জোর। পরে গঙ্গাইকোল্ড চোলপুরম চোল সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। রাজপ্রাসাদে অসংখ্য ভৃত্য, সভাসদ, কর্মচারী, নর্তক ও নর্তকী থাকত। চোল রাজারা তাঁদের সংগৃহীত রাজস্ব নানা দাতব্য কাজে ব্যয় করতেন। 

Related Posts

চোল সামরিক বাহিনীর শীর্ষে ছিলেন রাজা। চোল রাজাদের প্রতি সেনাদলের নিজস্ব নাম ও সংগঠন ছিল। সেনাদল দুর্গ, প্রাসাদ ও শিবিরে শান্তির সময় অবস্থান করত। যুদ্ধ করা ছাড়া, রাজস্ব আদায়ে সাহায্য করা, বিদ্রোহ দমন, মন্দির রক্ষা ছিল সেনাদের দায়িত্ব। যুদ্ধে জয়ের পর পরাজিত শত্রুর দেশের ধনসম্পদ লুঠ করা ছিল চোল যুদ্ধের নীতি। চোল সম্রাট প্রদেশ বা বিষয়ের শাসনকর্তাদের যে আদেশ দিতেন তা মন্দিরের দেয়ালে টাঙানো হত। রাজা দেশের প্রচলিত নিয়মে, রীতি-নীতির কথা মনে রেখে আইন জারী করতেন। চোল রাজকর্মচারীদের মধ্যে পদমর্যাদা অনুযায়ী শ্রেণী বিভাগ ছিল। সামরিক ও অসামরিক বিভাগের পার্থক্য ছিল না। বিভিন্ন পদ বংশানুক্রমিক হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বংশ কৌলিন্যকে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা হলেও, যোগ্যতাকে মূল্য দেওয়া হত। সরকারী কর্মচারীদের বেতন নগদ টাকায় দেওয়া হত না। নগদ বেতনের বদলে জমি দেওয়া হত। রাজা শাসনব্যবস্থা দেখার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিক্রমা করতেন।


প্রধানত কৃষিনির্ভর অর্থনীতি সেচব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে সমৃদ্ধ হয়। কাবেরী ডেল্টা ছিল ধান চাষের মূল কেন্দ্র। চোল রাজাদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি কর। নগদে অথবা ফসলের ভাগে এই কর আদায় করা হত। এছাড়া আমদানী, রপ্তানি শুল্ক, বাণিজ্য শুল্ক, নগরে প্রবেশ কর প্রভৃতি থেকে রাষ্ট্রের আয় হত। স্থানীয় প্রতিষ্ঠান-গুলি আলাদা কর আদায় করত। গ্রামসভাগুলি কেন্দ্রীয় কর আদায় করে দিতে বাধ্য ছিল। জমি, বাড়ির উপর কর ধার্য' হত। জমি জরিপ করা হত। ফসলের ঔ ভূমি রাজস্ব ছিল। জমির উর্বরতা অনুযায়ী করের হার ধার্য হত। ভূমি কর কঠোরভাবে আদায় করা হত। সংগৃহীত রাজস্ব থেকে শাসন কার্যে'র খরচ চালান হত। উদ্বৃত্ত কর রাজা খুসীমত ব্যয় করতেন। তোর সাম্রাজ্যে বন্দরনগরী কাবেরীপত্তিনম (পুহার), নাগাপট্টিনম থেকে বিদেশি বাণিজ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। চোল নৌবাহিনী সামুদ্রিক বাণিজ্য ও অভিযান - যেমন শ্রীবিজয় আক্রমণে-গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।



শাসনব্যবস্থার সর্ব' নিম্নে ছিল গ্রাম। কতকগুলি গ্রাম নিয়ে নাড়ু বা কোট্রম গড়া হত। বড় গ্রামের নাম ছিল তনিয়র বা কুররম। কয়েকটি কুররম নিয়ে মন্ডলম গঠিত হত। এখন প্রদেশ বলতে যা বুঝায়, মণ্ডলম তাই ছিল। চোল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ দিনে এই মন্ডলমের সংখ্যা ছিল ৮/৯। গ্রাম সভাগুলি বিচারের কাজ করত। এই রায়ের উপর নাড়ুর শাসকের কাছে আপীল করা যেত। রাজদ্রোহের বিচার রাজা নিজে করতেন। সাধারণতঃ অপরাধীদের জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়া হত অথবা বেত্রাঘাত করা হত।


চোল শিল্প ও স্থাপত্য দ্রাবিড় শৈলীর সর্বোচ্চ প্রকাশ। রাজরাজ চোল নির্মিত তাঞ্জাভুরের বৃহদীশ্বর মন্দির (UNESCO ঐতিহ্যস্থল) বিশাল গোপুরম, বিমন, ও সূক্ষ্ম ভাস্কর্যে অনন্য। গঙ্গাইকোন্ড চোলপুরম, দারাসুরামের মন্দিরও স্থাপত্যের উৎকর্ষে বিখ্যাত। কাঁসার ব্রোঞ্জমূর্তি (বিশেষত নটরাজ মূর্তি) চোল যুগের শিল্পকীর্তির শীর্ষে -যেখানে আধ্যাত্মিক প্রতীক ও বাস্তবমুখী ভঙ্গি মিলিত হয়েছে।



চোল যুগে তামিল সাহিত্য, বিশেষ করে 'পেরিয়পুরাণম'-এর মতো ভক্তিকাব্য ও শৈব-ভৈষ্ণব ভক্তিধারার তেভারম/দিভ্যপ্রবন্ধ গঠিত হয়। সংস্কৃত শিক্ষাকেও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় । চোলরা মূলত শৈবভক্ত তবে বৈষ্ণবধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের প্রতিও সহনশীল ছিলেন। শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিন্দুধর্ম প্রচারে চোল সাম্রাজ্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।


চোল স্বায়ত্ব শাসনব্যবস্থা ছিল খুবই উন্নত। গ্রামগুলি এই অধিকার ভোগ করত। উপরের স্তরে রাজার পরিবর্ত'ন হলেও গ্রাম শাসন একইভাবে চলত। গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দ্বারা একটি সমিতি গড়া হত। এই সমিতির নাম ছিল উর বা সভা। ব্যবসায়ীদের সমিতির নাম ছিল নগরম। এই সমিতি গ্রাম সম্পর্কিত সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করত। উর ও সভা অনেক সময় একত্রে কাজ করত। গ্রামের করদাতারা ছিল ঊরের সদস্য। সভা সাধারণতঃ ব্রাহ্মণদের গ্রামে স্থাপিত হত। ব্রাহ্মণ গ্রামগুলিতে সভার দ্বারা গ্রামের কাজ চলত। এছাড়া গ্রামে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমিতি ছিল। এই গোষ্ঠী নির্দিষ্ট বিষয়ে দেখাশোনা করত। গোষ্ঠীর কাজ গ্রামের ঊর বা সভার চূড়ান্ত দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল। রাজকর্মচারীরা উর বা সভার হিসাব-নিকাশ পরীক্ষা করত। উত্তর মেরুর গ্রামের একটি লেখ থেকে গ্রাম সভার পরিচালনা সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হয়েছে। গ্রাম সভার সদস্যের নিষ্কলঙ্ক নৈতিক চরিত্র এবং অর্থ তছরূপে সম্পর্কে কোন অপবাদ না থাকা দরকার ছিল। জ্ঞানী ও বয়স্ক লোকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হত। গ্রামের খাল, পুষ্করিণী, বাগান, রাস্তার জন্য উপসমিতি বা গোষ্ঠী তৈরী করা হত। গ্রাম সম্প্রদায়ের জমির উপর মহাসভার নিয়ন্ত্রণ ছিল। মহাসভা গ্রাম শাসনের জন্য নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায় করত। নগরম, উর বা সভার মতই কাজ করত। অনেকে নগরমকে বণিকদের নিগম বলে মনে করেন। এছাড়া নাড়ু শাসনের জন্য নাত্তার নামে এক সভ্য ছিল। গ্রাম শাসনের জন্য চোল রাজারা যে দুই শ্রেণীর বিশেষ কর্মচারী নিয়োগ করেন তাদের উপাধি ছিল "মধ্যস্থ” ও "করণত্তার"।



চোল যুগ প্রশাসনিক কাঠামো, বিকেন্দ্রীভূত গ্রামশাসন, সমৃদ্ধ কৃষি-বাণিজ্য, নৌবাহিনীর পরাক্রম এবং শিল্প-সাহিত্য-ধর্মীয় ভক্তির উৎকর্ষে দক্ষিণ ভারতের বিস্তৃত প্রভাবশালী পর্ব হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

Related Posts
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ চোল যুগের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব আলোচনা করো। এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟